লিখেছেন: আশিক মাহমুদ রিয়াদ
১.
টুনি তার দাদির কাছে শুনেছে এই মস্ত বড় পুকুরটি নাকি পরীরা তৈরী করেছে। দাদী অবশ্যি শুনেছে তার দাদীর কাছে।সেই দাদীর দাদী আবার কোন দাদীর কাছ থেকে জেনেছে তা জানা নেই। কোন এক পূর্নিমা রাতে পরিরা নাকি এসেছিলো এই সুদেবপুর গ্রামে। তাদের নাকে বড্ড মন খারাপ ছিলো সে সময়ে। পরিদের একজন বলে উঠলো,'ইসস! এখানে কোথাও পানি নেই, পুকুর নেই। সবুজ পরি ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে বলে পুকুর নেই তো কি হয়েছে বুবু? চল আমরা পুকুর খুড়ি! সেই রাতে পুকুর খোড়া হলো, মাটির তলদেশ থেকে জল ভরতে লাগলো ধীরে ধীরে৷ পুকুরে ঘাট বানানো হলো, তারপর পরিরা নাকি জলখেলায় মেতে উঠেছিলো। জলভরা টলমলে পুকুরটিকে কেন্দ্র করেই তৈরী হয়েছে সুদেবপুর গ্রামটি।
টুনির বয়স পনেরো কি ষোল। তার বাবা কাশেম মিয়া পেশায় কৃষক। বাড়ির উত্তরদিকে তাদের ধানীজমি আছে সেখানে প্রতিবছর ধান চাষ করেন তিনি। ধান চাষ শেষ হলে সেই জমিতে চাষ করেন ডাল,মরিচ।
টুনিরা পাঁচ ভাইবোন। সবার মধ্যে টুনিই বড়। টুনিদের বাড়িতে মোট ছ'খানা ঘর। টুনির বড় চাচা আব্বাস মিয়া আর ছোট চাচা রহমত মিয়ার দু খানা ঘর আছে এ বাড়িতে। বাড়ির উঠনের কোনে আছে একটি হাসনাহেনা ফুল। রাত বাড়লে সেই ফুল গন্ধ ছড়ায়,কেউ কেউ বলে হাসনাহেনা ফুলের গন্ধে নাকি সাপ এসে গাছে চড়ে বসে থাকে৷ অবশ্যি ছোট থাকতে টুনির হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ নাকে আসলেই কেমন যেন ভয় ভয় করত। আজকাল কেন যেন ভালো লাগে হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ। নিস্তব্ধ রাতে দাদি জাঁতি দিয়ে সুপারি কাটেন, পান ছ্যাঁচেন। টুনি গিয়ে দাদির পাশে বসে বলে,' দাদী পান দাও!' দাদী রসিকতা করে বলেন,'ওরে আমার বুড়িরে!এই বয়সে পান খাইলে জামাই পাবি না। '
সব মিলিয়ে টুনির এই গ্রামের প্রতি বেশ মায়া হয়,মায়া হয় গ্রামের মানুষদের প্রতি! কি সুন্দর অবলীলায় সৃষ্টি কর্তা সাজিয়েছেন এই জগৎ কে৷ জগৎটা কত সুন্দর!
২.
দুপুর বেলা ছোট চারটে ভাই বোনকে নিয়ে পুকুর ঘাটে বসে ছিলো টুনি। এখন শীতকাল, দিন ছোট।
টুনির দাদী জামিলা বেগম বারান্দায় বসে সুপারি কাঁটছিলেন। কাশেম মিয়া এসে জামিলা বেগমকে বলল,'আম্মা একটা খুশি খবর আছে! ' জামিলা বেগম সুপারি কাটা রেখে বললেন,'কিসের খুশির খবর?' কাশেম উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল,'আগে আমারে একখান পান খাওয়াও দেহি! তারপর বলুম। ' জামিলা বেগম পান সাজিয়ে কাশেম মিয়ার হাতে দিলেন। কাশেম নিয়া পান চিবাতে চিবাতে পিক ফেলল। তারপর আঙুলের মাথায় চুন দাতে লাগাতে লাগাতে বলল,'আমগো টুনির জন্য একখান ভালো পোলা পাইছি। ' জামিলা বেগম নিজের জন্য পান ছ্যাঁচা থামিয়ে বলল,'কি কস এইসব?আমগো টুনি তো এহনো ছোড। ওর কি বিয়ার বয়স হইছে? মাইয়াডা মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ে। এর মধ্যেই বিয়ার চিন্তা করতাছোস?' কাশেম বলল,'মা! তুমি তো জানোই! মাইয়াডা তো আমার বড় হইছে। দেখতে শুনতেও মাশাল্লাহ! তাইলে আর দেরী করুম কি করতে? তাছাড়া, এত বড় সংসারের খরচ টানতে টানতে আমি শেষ হইয়া যাইতাছি। এর থৈকা মাইয়াডারে বিয়া দিয়া দেই? পোলাও তো ভালো। উত্তরকান্দার বাজারে সারের দোকান আছে। পোলাগো বাড়িতে পাকা দালান! জামিলা বেগম পান মুখে দিতে দিতে বলল,'তোগো যা মন চায় কর! আমি বুড়া মানুষ তোগো বোঝা! আইজ আছি কাইল নাই। '
৩.
টুনির বেশ মন খারাপ আজকাল। মা তাকে আর স্কুলে যেতে দেয় না। বাবার নির্দেশ। স্কুল বন্ধ৷ টুনি সারাদিন পুকুর পাড়ে বসে থাকে।পুকুরের পানি টলমল করে! হঠাৎ হঠাৎ পানিতে মাছ ঘাউ মেরে ওঠে।
টুনির হাতে মেহেন্দি লাগানো হচ্ছে।মেহেন্দি লাগাচ্ছে টুনির এক চাচাতো বোন। টুনির বান্ধবীরা এসেছিলো বিয়েতে। তারা টুনিকে দেখে মনখারাপ করেছে। টুনিরো কেমন লজ্জা লজ্জা হচ্ছে, বাড়িতে সবাই আনন্দ ফুর্তি করছে৷টুনির বাবা একখানা নতুন লুঙ্গি আর ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি পরে ঘুরছে, এদিক সেদিক দেখছে৷ মাঝেমাঝে কাউকে কাউকে ধমকাচ্ছে। টুনি আনমনা হয়ে বসে আছে৷ তার বড় স্বপ্ন ছিল,সে ডাক্তার হবে। মানুষের চিকিৎসা করবে। টুনির মা মারা গিয়েছিলেন চিকিৎসার অভাবে। টুনির বড় কষ্ট হয়, কাঁদতে ইচ্ছে করে।
টুনি তার দাদীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। জামিলা বেগম বলল,'দেহো মাইয়ার কান্ড!কান্দোস ক্যা?' টুনি কাঁদতে কাঁদতে বলল,'দাদী! আমি ডাক্তার হইতে চাই। তুমি বোঝাও একটু বাপজানরে। আমি বিয়া করুম না। ' টুনির দাদী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,'তোর বাপে কি আমার কথা হুনবো! হারামজাদা তো ছোডকাল থেইকাই মাথা ভাঙ্গা। '
৪.
আজ শুক্রবার। টুনির বিয়ের আসর তৈরী করা হয়েছে। কাশেম মিয়া চিল্লাফাল্লা করচ্ছে। বর যাত্রী আসবে আরেকটু পরে।
টুনিকে লাল বেনারসি শাড়ি পড়িয়ে বউ সাজানো হয়েছে৷ টুনি তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। টুনির এক চাচী টুনিকে দেখে ঠাট্টা করে বলল,'দেখো! আমাগো টুনিরে কত সুন্দর লাগতেছে। জামাই বাবাজি দেইখাই ফিট পড়বো। ' টুনির দাদীকে দেখা যাচ্ছে না।
জামাই এসেছে! ব্যান্ডপার্টি বাজনা বাজাচ্ছে! টুনিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিয়ের আসরে। বিয়ে করতে আসা লোকটি টুনির দিকে তাকাচ্ছে লাজুক লাজুক চোখে টুনির দিকে তাকাচ্ছে। টুনি তাকিয়ে আছে নিচের দিকে,সে আনমনা। কাজী সাহেব এসেছেন! সবার চোখেমুখে আনন্দ।
হঠাৎ,বিয়ের আসরে প্রবেশ করলো টুনির দাদী। সাথে আছে টুনির কয়েকজন বান্ধবী। লোকজনের চোখেমুখে কেমন আতংক। খাকি পোশাক পড়া পুলিশ এসেছে! টুনি জামাইয়ের পাশ থেকে লাফ দিয়ে উঠে তার দাদিকে জড়িয়ে ধরলো। টুনির সহপাঠিরা আগলে রাখলো টুনিকে।
Comments
Post a Comment