Skip to main content

অপরূপ স্বরূপকাঠি



আচ্ছা নদীতে হেঁটেছেন কখনো? না মানে শুধু নদীর তীরে পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নয়, নয় শুকনো কোনো নদীতে পায়ে হাঁটাও। একদম ভরা আর গভীর নদীতে হেঁটেছেন কখনো? হেঁটে হেঁটে কখনো কি পার হয়েছেন কোনো নদী? এপার থেকে ওপার? চলুন আজকে তেমন একটা অদ্ভুত নদী আর স্বরূপে সেজে থাকা একটা তথাকথিত ট্যুরিস্ট স্পটের বাইরের গল্প করি।

আমরা যারা বেড়াতে ভালোবাসি তাদের অধিকাংশই বেড়ানো বলতে শুধু পাহাড়বেষ্টিত বান্দরবান, লেক-পাহাড়ের রাঙামাটি, বর্তমান সময়ের ক্রেজ সাজেক সঙ্গে খাগড়াছড়ি, চিরাচরিত উচ্ছ্বাসের কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন আর সবুজ সমুদ্রের সিলেটকেই বুঝি। এর বাইরেও ভ্রমণপিপাসুদের কাছে দেশের একদম অপরিচিত কোনো অঞ্চল আছে যেখানে প্রকৃতি তার পরিপূর্ণতা নিয়ে বসে আছে আপনাদের অপেক্ষায় যেটা অনেকেই জানেন না। বা জানার সুযোগ হয়নি। তবে আজকে না হয় তেমন একটা অঞ্চলের সঙ্গে পরিচিত হই, কী বলেন?

আমরা সবাই বরিশাল বলতে শুধু ধান-নদী আর খালকেই বুঝি। কিন্তু না, পর্যটনের এই ভরা মৌসুমে আসুন জেনে নিই, ধান-নদী আর খালের বাইরে আর কী কী আছে বরিশালে, যা পর্যটকদের জন্য উপভোগ্য হতে পারে?

আপনারা অনেকেই হয়তো ভারতের কেরালায় গিয়ে থাকবেন বা ইন্টারনেটে ছবি অন্তত দেখে থাকবেন। যদি একবার দুই–এক দিনের সময় নিয়ে যেতে পারেন পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে, তাহলে দেশেই পাবেন কেরালার ছোঁয়া।

চারদিকে পানি, ছোট ছোট খাল, মৃদু ঢেউ, দুলে চলা নৌকা বা হাউস বোট, দুই ধারে গ্রামীণ জীবন, নারকেল-সুপারি আর কলাগাছের সারি, দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ-সবুজ ধানখেত, নদীর বাঁকে বাঁকে ডিঙি নিয়ে মাছের অপেক্ষা, ঘাটে ঘাটে নৌকায় করে বিকিকিনি, যত দূর চোখ যায় সাদা-গোলাপি শাপলা ফুলের মনোমুগ্ধকর রূপ, মাইলের পর মাইলজুড়ে সবুজ-সাদা-হলুদ পেয়ারার হাজারো গাছে ঝুলে থাকা, কচুরিপানার স্তূপে মাইলের পর মাইলজুড়ে ভাসমান সবজি আর আখের চাষ, আর সবচেয়ে জাদুকরি হলো সন্ধ্যা নদীর বড় বড় ডিমওয়ালা ইলিশ! যা একবার খেলে সারা জীবনে চাইলেও ভুলে থাকা সম্ভব হবে না। আর একদম ভরা নদীতে হেঁটে হেঁটে এপার থেকে ওপারে যাওয়ার অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারবেন এই স্বরূপকাঠিতে! তবে আপনাকে যেতে হবে কোনো এক সোম বা বৃহস্পতিবার, যেদিন সেখানে সাপ্তাহিক হাট বসে। এই হলো পিরোজপুর আর তার মাঝখানে অবস্থিত স্বরূপে সেজে থাকা স্বরূপকাঠি।

হাটের দিন গাছ ও নৌকার ওপর দিয়ে সন্ধ্যা নদী হেঁটে পারাপার হওয়া যায়। ছবি: মারিয়া আফরোজ
হাটের দিন গাছ ও নৌকার ওপর দিয়ে সন্ধ্যা নদী হেঁটে পারাপার হওয়া যায়। ছবি: মারিয়া আফরোজ
ঢাকা থেকে স্বরূপকাঠি যাওয়ার সবচেয়ে আরামদায়ক আর বিলাসবহুল উপায় হচ্ছে সদরঘাট থেকে সন্ধ্যায় লঞ্চে উঠে সারা রাতের ভ্রমণ। এই ভ্রমণে পাবেন সীমাহীন জলরাশি, উড়ে যাওয়া গাঙচিল, চিরসবুজ গ্রামের যাপিত জীবন, জেলেদের জলের আবাস, গোধূলির রঙিন আলো আঁধার আর রাতের নীরবতা। নিজেকে নিজের প্রশ্ন করার অবারিত অবসর আর ব্যস্ত জীবনের বাইরে কিছু অবসর। সঙ্গে মনের মাঝে জমে যাওয়া কিছু গল্প।

সকালে স্বরূপকাঠি নেমে নাশতা করে নিতে পারেন যেকোনো হোটেলে বা লঞ্চঘাটে। এরপর সোজা একটা ট্রলার ভাড়া করে যেতে পারেন সাঁতলা, যেখানে মাইলের পর মাইল পানিপথ বা বিলজুড়ে রয়েছে গোলাপি শাপলা ফুলের মনোমুগ্ধকর আয়োজন। একটি ডিঙিতে করে ভেসে বেড়ান সাঁতলার শাপলার বিলে। কতক্ষণ ভেসে বেড়াবেন সেটা একান্তই আপনার ইচ্ছা। স্বচ্ছ জলে চোখ নামালে দেখতে পাবেন শত রঙের শেওলা, রংবেরঙের মাছ, ইচ্ছে হলে নেমে পড়তে পারেন একটু নরম আর ঠান্ডা পানিতে, ভিজিয়ে নিতে পারেন নিজেকে। চেখে দেখতে পারেন মিষ্টিপানির দারুণ সুস্বাদু মাছ।

সময় করে যেতে পারেন আরও গভীরের কোনো বিলের দিকে, যেখানে কচুরিপানা জমা করে স্তূপে স্তূপে সাজিয়ে বানানো হয়েছে ভাসমান বাগান বা সবজি চাষের এক অনবদ্য আর নান্দনিক উপায়। যত দূর চোখ যায় ভাসমান বাগান, নানা রকমের সবজি, নার্সারি, ফুলের চাষ, আখের উৎপাদন আর কত কী যে আছে না দেখলে বোঝানো সম্ভব নয়। তাই সেই অনবদ্য ভাসমান বাগান আর নার্সারি না হয় একবার ভেসে ভেসে উপভোগ করে আসুন।

গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে পানির নরম পথ পেরিয়ে ফিরে আসতে পারেন স্বরূপকাঠি, একটি থাকার জায়গা ঠিক করে বেরিয়ে পড়তে পারেন হেঁটে হেঁটে নদীর এপার থেকে ওপার যাওয়ার অসম্ভবকে সম্ভব করতে। যদি সেদিন সাপ্তাহিক হাটের দিন হয়। দেখবেন পুরো নদীজুড়ে শুধু নৌকা আর নৌকা, হাজার হাজার নৌকা, গাছ নিয়ে পুরো নদীজুড়ে ভেসে আছে বিকিকিনির জন্য। যে নদীর এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে চলে যেতে পারবেন অনায়াসে, গাছের নৌকার ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে। বাজারের কোনো এক হোটেলে ঢুকে পেটপুরে খেয়ে নিতে পারেন সন্ধ্যা নদীর তরতাজা ইলিশের অমৃত আর বাদামি করে ভেজে রাখা বড়সড় লম্বা ডিম। যা মনে থাকবে আজীবন।

শেষ বিকেল আর সন্ধ্যাটা হেঁটে বেড়াতে পারেন জীবনানন্দের বিখ্যাত সন্ধ্যা নদীর তীরে অথবা দুলতে পারেন হালকা ঢেউয়ের দোলায়। খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে স্পর্শ করতে পারেন নরম কাদার পরম সুখ! সত্যিই যদি একবার খালি পায়ে নামতে পারেন নরম নদীর তীরের তুলতুলে কাদায় তাহলে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যাবে শরীর আর মনে।

সন্ধ্যা নেমে আঁধার হলেও চাইলে বসে থাকতে পারেন নদীর তীরে জেগে থাকা কোনো শিকড়ে বা গাছের গুঁড়িতে। দেখতে পারেন সন্ধ্যা নদীর বুকে ঢলে পড়া চাঁদ, উপভোগ করতে পারেন মৃদু জ্যোৎস্না, জেলেদের রুপালি ইলিশ ধরার দুর্লভ দৃশ্য। গায়ে মাখাতে পারেন ঝিরঝিরে বাতাসের মিষ্টি পরশ। সবকিছু মিলিয়ে কাটাতে পারেন অনাবিল কিছু সময়।

আর যদি যেতে চান ভরা বর্ষায় তবে এসবের পাশাপাশি পাবেন পেয়ারার এক ভাসমান বাজার। যেটার শুরু স্বরূপকাঠি থেকে আর শেষ হয় গিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরের আটঘর কুরিয়ানায়। যেখানে সারি সারি পেয়ারার বাগান। যার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট খাল। ডিঙিতে পেয়ারাবাগানের ভেতরে যাওয়া যায়। চাইলেই পেড়ে খেতে পারেন ইচ্ছেমতো। তবে হ্যাঁ, শুধু খেতেই পারবেন, সঙ্গে করে আনতে হলে অবশ্যই কিনে আনতে হবে। এখানে যেতে হলে রাতের লম্বা লঞ্চ ভ্রমণ শেষ করে সকালে নেমেই চলে যাওয়া ভালো। ছোট নৌকা রিজার্ভ করে যেতে পারেন। যতক্ষণ খুশি পেয়ারাবাগান উপভোগ করে ফিরে আসতে পারেন বা চাইলে থেকেও যেতে পারেন, কোনো এক জায়গায়।

আর যদি যান ভাসমান ভেলায় ভেসে ভেসে, দুলে দুলে রাত কাটাতে চান তবে কয়েকজন মিলে ভাড়া করে নিতে পারেন কোনো এক বড়সড় ছই–অলা নৌকা। যেখানে কাটাতে পারেন একটি দুর্লভ রাত, নদীর মাছ কিনে ভাজা করে খাবেন সেখানেই, রাতে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখবেন আর তারা গুনবেন রাতভর সন্ধ্যা নদীর ঢেউয়ে দুলে দুলে।

এই হলো স্বরূপকাঠি, যার স্বরূপ বুঝতে একবার ঘুরে আসতেই হবে।

Comments

Popular posts from this blog

পিরোজপুর সদরের কিছু উল্লেখযোগ্য মজাদার খাবার ও খাবারের স্থানের নাম

১.আইচ পুরি ভান্ডার এর পুরি।দামুদার ব্রীজের ঠিক এক পাশেই ছোট্ট করে এই পুরির দোকান  । অনেক জায়গায় পুরি খেলেও এটাকে আপনার বেস্ট বলতে হবে কারন ডাল পুরিতে অনেক ডাল এবং আলু পুরিতে অনেক আলু দেয়।  সন্ধ্যার পর ভরপুর গরম গরম পুরি খাওয়ার লাইন‌ লাগে এই দোকানে । প্রতিটা পুরি মাত্র ৫ টাকা। যে পরিমাণ আলু,ডাল ‌ঠুসায় সেই তুলনায় দাম কমই বলা চলে।ট্রাই করতে পারেন কোন এক সন্ধ্যায় । ২.সিও অফিস, ডাচ বাংলা বুথের পাশের চায়ের দোকানের গরুর দুধের চা। ৩.জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটে অবস্থিত ক্যাফে স্ট্রিট ফুড এর মালাই চা।পরিবেশন স্টাইল দারুন।দাম মাত্র ১৫ টাকা। ৪.দুলালের দধি ভান্ডারের রসগোল্লা, রসমালাই, দধি। ৫.ভাই ভাই মিস্টির দোকানের রসগোল্লা,দধি,রসমালাই। ৬.বেকুটিয়া ফেরিঘাটের রাস্তার পাশের ঝাল মুড়ি। ৭.পিরোজপুর পুরান বাসস্ট্যান্ডে খুলনা বাস কাউন্টারের পাশে দোকানের চিতই পিঠা।পিঠার সাথে মরিচ ভর্তা আর সরিষা ভর্তাটা জোশ লাগে। ৮.শেরে বাংলা মার্কেট এর বিপরীতে স্টার হোটেলে হট কফি। ৯.সিও অফিসের ওখানে ক্যাফে আল মদিনার চকলেট হট কফি,চকলেট কোল্ড কফি । দাম ৫০-৬০ টাকার মত লিখেছেন :জি,এম-আদল

পিরোজপুর জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ

    লিখেছেন : জি,এম-আদল পিরোজপুর বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা।প্রকৃতি তার নিজ সাজে অপরুপ সৌন্দর্যে পিরোজপুর জেলাকে সাজিয়েছেন। নদীবিধৌত জেলা পিরোজপুরে রয়েছে সেরা কিছু দর্শনীয় স্থান।পিরোজপুর সদর, ইন্দুরকানি, নাজিরপুর, কাউখালী, ভান্ডারিয়া, মঠবাড়ীয়া, নেছারাবাদ এই সাতটি উপজেলা নিয়ে পিরোজপুর জেলা গঠিত। এই উপজেলাগুলোর প্রায় প্রতিটি উপজেলারই রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য, রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান।সেরা দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে ভাসমান পেয়ারা হাট, কবি আহসান হাবিব এর পৈত্রিক ভিটা,রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি,হরিনপালা রিভারভিউ ইকো পার্ক, ভান্ডারিয়া শিশু পার্ক,ভান্ডারিয়া মিয়া বাড়ি মসজিদ,মঠবাড়িয়ার মমিন মসজিদ, পিরোজপুর এর ডিসি পার্ক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।  ভাসমান পেয়ারা হাট : পিরোজপুর জেলার স্বরুপকাঠি উপজেলার আটঘর,কুরিয়ানা নামক জায়গায়  নৌকায় করে এই (Floating Market) ভাসমান পেয়ারা হাট বসে। কবি আহসান হাবিব এর পৈত্রিক ভিটা: কবি আহসান হাবীব একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলা ভাষার অন্যতম একজন খ্যাতনামা কবি।  আহসান হাবীব এর জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি,পিরোজপুর সদর...

পিরোজপুর জেলা নামকরণের ইতিহাস

পৃথিবী সৃষ্টির পিছনে যেমন ইতিহাস রয়েছে ঠিক তেমনি পৃথিবীর প্রতিটি দেশ,বিভাগ,জেলা ও এলাকা সৃষ্টির পিছনে রয়েছে হাজারো গল্প ও ইতিহাস। তেমনি পিরোজপুর জেলা সৃষ্টি ও নামকরণের পিছনেও রয়েছে নানা গল্প ও ইতিহাস। গবেষকদের মতে,আজকের এ পিরোজপুর সুলতানি আমলে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ অঞ্চল পরিচিতি ছিল ফিরোজপুর নামে। মোগল সম্রাট শাহসূজার অকাল প্রয়াত পুত্র ফিরোজশাহের নামে 'ফিরোজপুর' এবং পরে অপভ্রংশ হিসেবে 'পিরোজপুর' নামকরণ হয়েছে। নাজিরপুর উপজেলার শাখারী কাঠির জনৈক হেলালউদ্দীন মোঘল নিজেকে মোঘল বংশের শেষ বংশধর হিসেবে দাবী করেছিলেন। তাঁর মতে বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজা আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার নিকট পরাজিত হয়ে বাংলার দক্ষিণ অঞ্চলে এসেছিলেন এবং আত্মগোপনের এক পর্যায় নলছিটি উপজেলার সুগন্ধা নদীর পারে একটি কেল্লা তৈরি করে কিছুকাল অবস্থান করেন। মীর জুমলার বাহিনী এখানেও হানা দেয় এবং শাহ্ সুজা তার দুই কন্যাসহ আরাকানে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি অপর এক রাজার চক্রান্তে নিহত হন। পালিয়ে যাওয়ার সময় তার স্ত্রী  এক শিশু পুত্রসহ থেকে যায়। পরবর্তীতে তারা অবস্থান পরিবর্তন করে ধীরে ...