লিখেছেন :রোমেনা লেইস
পৃথিবীতে যুদ্ধকালে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে নারীরা। প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধরত সৈন্যদের দেখা গেছে একা কিংবা দল বেঁধে নারীদের ধর্ষণ করতে। বাংলাদেশের জন্মের সময় অর্থাৎ, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধর্ষিতা হয়েছেন আমাদের দেশের মা-বোনেরা। কিশোরী থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত নির্যাতিত হয়েছেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারা ধর্ষণ করেছে। কী হিন্দু, কী মুসলিম—বহু নারীই বাঁচাতে পারেনি সম্ভ্রম। একাত্তরে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা তিন লাখ নারীকে ধর্ষণ করেছে, বন্দিশিবিরে আটকে রেখে ভয়াবহ নির্যাতন করেছে এবং অসংখ্য নারীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তবুও তাঁরা পাকিস্তানিদের সঙ্গে আপস করেননি। অনেকে জীবন দিয়েছেন, তবু প্রকাশ করেননি মুক্তিযোদ্ধা স্বামী, ভাই, বাবা বা অন্যদের পরিচয়। আবার অনেক নারী অস্ত্র হাতে যুদ্ধও করেছেন রণাঙ্গনে। শিরিন বানু মিতিল, তারামন বিবি, কাঁকন বিবি—এমনই বীর নারীদের মতো আরও অনেকে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর তাঁদের পরিচয় সেভাবে সামনে আসেনি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গেরিলা অপারেশনের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। যুদ্ধের খবর আদান-প্রদান, অস্ত্র পৌঁছে দেওয়া, যোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, বাড়িতে আশ্রয় দান, খাবার রান্না করে দেওয়া, পাকিস্তানিদের গতিবিধির খবর জোগাড় করা—এসবই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশটির সিংহভাগ করেছিলেন নারীরা। তাঁরা এই ভূমিকা পালন করেছিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, চরম নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা নিয়েই। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া, খাবার সরবরাহ করা, অস্ত্র ও গোপন সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার মতো প্রতিটি ভূমিকার জন্য অসংখ্য বাঙালি নারীকে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করেছে, ক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ ও চরম নির্যাতন করেছে। কিন্তু নারীর এই বীরত্বের জন্য স্বাধীন দেশে তাঁকে তেমন কোনো স্বীকৃতিই দেওয়া হয়নি।
ভারতে আশ্রয় শিবিরে নারীরা নার্স ও চিকিৎসক হিসেবে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন। শরণার্থীশিবিরেও অসুস্থদের সেবা দিয়েছেন নারী। ডা. সিতারা বেগম বীরপ্রতীক খেতাব পেলেও অন্য নারীরা কিন্তু কিছুই পাননি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও অনেক নারী কণ্ঠসৈনিক ছিলেন। ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া এমনই একজন ভাগীরথী।
পিরোজপুর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মহকুমা শহর। অষ্টাদশী ভাগীরথী ছিল বরিশাল জেলার পিরোজপুরের বাঘমারা থানার কদমতলীর এক বিধবা নারী। বিয়ের এক বছর পর একটি পুত্র সন্তান কোলে নিয়েই সে বৈধব্য বরণ করেছিল। স্বামীর বিয়োগ ব্যথা তখনো কাটেনি তাঁর। এরই মধ্যে দেশে নেমে এল ইয়াহিয়ার ঝটিকা বাহিনী। ১৯৭১ সালের মে মাসের এক বিকেলে ওরা চড়াও হলো ভাগীরথীদের গ্রামে। হত্যা করল অনেককে, যাকে যেখানে যেভাবে পেল। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল গ্রামের ঘরবাড়ি। এই নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের মধ্যেও ভাগীরথীকে ওরা হত্যা করতে পারল না। ওর শরীর তাদের মনে যে লালসা জাগিয়েছিল, তাতেই হার মানল তাদের রক্তপিপাসা। ওকে ট্রাকে তুলে নিয়ে এল তারা পিরোজপুরে। তারপর ক্যাম্পে তাঁর ওপর চালানো হলো হিংস্র পাশবিক নির্যাতন, অত্যাচার।
পিরোজপুরের ভাগীরথী, যিনি নিজের জীবন দিয়ে অন্যরকম যুদ্ধ করেছিলেন, আজ বলি তাঁর কথা। বাংলার অষ্টাদশী মেয়ে ভাগীরথী স্বেচ্ছায় নিজের দেহ দিয়ে পাকিস্তানিদের খুশি করতেন। প্রথমে ভাগীরথী মরে যেতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু একসময় এল নতুন চিন্তা। ভাবলেন, ‘হ্যাঁ, মৃত্যুই যদি বরণ করতে হয়, ওদেরই বা রেহাই দেব কেন?’ ভাগীরথী কৌশলের আশ্রয় নিলেন এবার। এখন আর অবাধ্য মেয়ে নন তিনি। দস্তুরমত খানদের খুশি করতে শুরু করলেন তিনি। ওদের আস্থা অর্জনের আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগলেন। বেশি দিন লাগল না। অল্প কয়েক দিনেই আস্থা অর্জনে সক্ষম হলেন। তারপর ভাগীরথী ওদের কাছ থেকে জেনে নিতে শুরু করল পাকিস্তানি বাহিনীর সব গোপন তথ্য। একপর্যায়ে বিশ্বাসভাজন ভাগীরথীকে ওরা নিজ গ্রামে ফিরে যেতেও দিল। আর কোনো বাধা নেই। ভাগীরথী এখন নিয়মিত সামরিক ক্যাম্পে যায়। আবার ফিরে আসে নিজ গ্রামে। এরই মাঝে ভাগীরথী তাঁর মূল লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়েও গেলেন অনেকখানি। গোপনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে গড়ে তুললেন যোগাযোগ। এরপরই এল আসল সুযোগ। জুন মাসের একদিন ভাগীরথী খানসেনাদের নিমন্ত্রণ করলেন নিজের গ্রামে। এদিকে মুক্তিবাহিনীকেও তৈরি রাখা হলো। ৪৫ জন খানসেনা সেদিন হাসতে হাসতে কদমতলা গ্রামে এসেছিল। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ৪/৫ জন ক্যাম্পে ফিরতে পেরেছিল, তাও বুলেটের ক্ষত নিয়ে। বাকিরা ভাগীরথীর গ্রামেই শিয়াল, কুকুর ও শকুনের খোরাক হয়েছিল।
এরপর আর ভাগীরথী ওদের ক্যাম্পে ফিরে যাননি। ওরাও বুঝেছে এটা ওরই কীর্তি। কীর্তিমানরা তাই হুকুম দিল জীবিত ভাগীরথীকে যে ধরিয়ে দিতে পারবে, তাকে নগদ এক হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। একদিন রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লেন ভাগীরথী। তাঁকে নিয়ে এল তারা পিরোজপুর সামরিক ক্যাম্পে। পাকিস্তানি সেনারা এবার ভাগীরথীর ওপর চড়াও হলো। এক হাটবারে তাঁকে শহরের চৌমাথায় এনে দাঁড় করানো হলো। সেখানে প্রকাশ্যে তাঁর সব পোশাক খুলে ফেলল কয়েকজন সৈন্য। তারপর দু গাছি দড়ি তাঁর দু পায়ে বেঁধে একটি জিপে বেঁধে জ্যান্ত তাঁকে শহরের রাস্তায় টেনে বেড়াল তারা। ঘণ্টাখানেক রাজপথে এভাবে চলার পর আবার যখন ফিরে এল সেই চৌমাথায়, তখনো তাঁর দেহে মৃদু প্রাণের স্পন্দন রয়েছে। এবার তারা দুটি পা দুটি জিপের সঙ্গে বেঁধে নিল এবং জিপ দুটিকে চালিয়ে দিল বিপরীত দিকে। ভাগীরথী দুভাগ হয়ে গেলেন। সেই দু ভাগ দুই জিপে আবার শহর পরিক্রমা শেষ করে জল্লাদের দল আবার ফিরে এল সেই চৌমাথায় এবং সেখানেই ফেলে রেখে গেল সেই মাংসপিণ্ডগুলো, যা ওই রাস্তাতেই মিশে গেল একসময়। বাংলা মায়ের ভাগীরথী আবার এমনিভাবে মিশে গেল বাংলার ধূলিকণার সঙ্গে।
বাংলা মায়ের নাড়ি ছিঁড়ে জন্ম নিয়েছিল যে সোনার মেয়ে, সে ভাগীরথীকে ওরা জ্যান্ত জিপে বেঁধে শহরের রাস্তায় টেনে টেনে হত্যা করেছে। পাকিস্তানি সেনারা হয়তো দেখাতে চেয়েছিল যে, ওরা কতখানি নৃশংস হতে পারে। বলতে হয়, এ ক্ষেত্রে তারা শুধু সফলই হয়নি, বরং বর্বরতার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
পিরোজপুরের ভাগীরথী, যিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে এ দেশের স্বাধীনতা আনতে সহায়তা করেছিলেন। আসুন আজ বিজয় দিবসের প্রাক্কালে সবাই মিলে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই এই মহীয়সী নারীকে। দেশের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিলেও তিনি পাননি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। ভাগীরথীর মতো আরও অনেক নারী স্বাধীনতার বেদিতে বলিদান করেছেন নিজের জীবন। তবুও ভাগীরথীর মতো মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য নারীর আত্মত্যাগ ও সাহসী ভূমিকার কথা অনেকটা ইতিহাসের আড়ালেই রয়ে গেছে।
তথ্য সুত্র-প্রথম আলো।
Comments
Post a Comment