লিখেছেন :মো:রাব্বানী
অতিথি লেখক,নোয়াখালী।
ভ্রমণের সাথে আমাদের সবারই কম বেশি মজার অভিজ্ঞতা থাকে। কখনো ভ্রমনকালে আবার কখনো ভ্রমনে অবস্থানরত জায়গায় ঘটে থাকে মজার কিছু ঘটনা। বিখ্যাত ব্যক্তিরাও এর ব্যাতিক্রম নয়। আজকের লেখা এমনই কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভ্রমণের মজার কিছু ঘটনা নিয়ে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একবার চীন ভ্রমণকালে, চীনা কর্তৃপক্ষ কবিগুরুর পছন্দের কথা ভেবে বাংলাদেশ থেকে আম আনালেন। তখন এত ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না আর খাবারে কোন রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হতো না। তাই আম যখন চীনে পৌছালো তখন আম শুকিয়ের চুপসে দেখতে অন্যরকম হয়ে গিয়েছিলো। এদিকে চীনের কর্তৃপক্ষ আম ওভাবে চিনতো না, তাই তারা ওই শুকিয়ে যাওয়া আম কবিগুরু কে খেতে দিতে পেরে খুব খুশি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আম মুখবুজে খেয়ে নিলেন। কিন্তু যখন তাঁর সফর সঙ্গি শাস্ত্রী মশাই জিজ্ঞাসা করলেন, “কেমন আম খেলেন গুরুদেব?” মৃদু হেসে কবি জবাব দিলেন, “আম খেতে খেতে মনে হচ্ছিলো এক রবীন্দ্রনাথ আরেক রবীন্দ্রনাথের দাঁড়িতে তেতুল-গুঁড় মেখে খাচ্ছে।”
সমুদ্র ভ্রমণ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মজার অভিজ্ঞতা আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রথম সমুদ্র ভ্রমনের অভিজ্ঞতার ব্যাপারে লিখেছিলেন, “কল্পনায় সমুদ্রকে যা মনে করতাম সমুদ্রে এসে দেখি তাঁর সঙ্গে অনেক বিষয় মিলে না। তীর থেকে সমুদ্রকে খুব মহান মনে হয় কিন্তু সমুদ্রের মধ্যে এলে আর ততটা মহান মনে হয় না।” তবে তারপরই উনি আবার রসিকতা করে বলেছিলেন, “বাল্মিকি থেকে রামায়ন পর্যন্ত সবারই এই সমুদ্র দেখে ভালো লাগে আর আমার যদি ভালো না লাগে তবে দশজনে হেসে উঠবে।”
বিজ্ঞানি আইনস্টাইন
আইনস্টাইনের আমেরিকা ভ্রমনের সময় ঘটে এক মজার ঘটনা। সেইসময় আইনস্টাইনের ‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি’ খুব কম বিজ্ঞানিই বুঝতে পেরেছিলেন। সেই সময় তাকে একবার সস্ত্রীক আমেরিকা ভ্রমনের আমন্ত্রন জানানো হয়। আইস্টাইন জাহাজে করে আমেরিকা যাওয়ার জন্য রওনা হলেন। জাহাজ থেকে নামার সাথে সাথেই তাকে সাংবাদিকরা ঘিরে ধরে নানা রকম প্রশ্ন করতে থাকে। এক সাংবাদিক মজার একটি প্রশ্ন করেন। প্রশ্নটা ছিল “আচ্ছা, বলুন তো মেয়েরা আপনাকে এত পছন্দ করে কেন?” আইনস্টাইন মৃদু হেসে উত্তর দিলেন , “আপনি জানেন কিনা জানি না তবে মেয়েরা সবসময় লেটেস্ট ফ্যাশন পছন্দ করে আর এই বছরের ফ্যাশন হল ‘থেওরি অফ রিলেটিভিটি’, আমাকেও ওটার অংশ হতে হয়েছে কিনা।”
Vromon Guide App
আরেকবার, ১৯২১ সালে ফিলিস্তিন ভ্রমনের একটি ঘটনা। ফিলিস্তিন শহরে ‘যুব সংঘ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের একটি সেমিনারে যোগ দিতে গিয়েছে আইস্টাইন। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন ২২ বছরের এক তরুণী। সমাজের নানা বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করছিলেন আইস্টাইন। প্রশ্নের এক পর্যায়ে আইস্টাইন তার কাছে জানতে চাইলেন, “আচ্ছা এখানে নারী পুরুষের সম্পর্ক কেমন?” এই প্রশ্ন শুনে ওই তরুণী খুব লজ্জায় পড়ে গেলেন। তিনি বললেন, “দেখুন অধ্যাপক, এখানে কিন্তু একজন পুরুষের একটিই স্ত্রী।” আইনস্টাইন উত্তরটা শুনে একটু হেসে তরুণীর হাত ধরে বললেন , “না না, আমার প্রশ্নটা ওভাবে নিয়ো না। আমরা পদার্থ বিজ্ঞানিরা ‘সম্পর্ক’ কথাটা দিয়ে সহজ কিছু বুঝাই। আমি আসলে জানতে চেয়েছি, এখানে কতজন নারী আর কতজন পুরুষ।” সত্যিই বিজ্ঞানি হবার সাথে সাথে ওনার হাস্যরসবোধও ছিল সবার জন্য উপভোগ্য।
জওহরাল নেহেরু
জওহরাল নেহেরু যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন ক্রুশেভ এসেছিলেন ভারত সফরে। নেহেরু ক্রুশেভকে নিয়ে পার্টি অফিসে সংবর্ধনায় যোগ দান করতে বের হলেন। রাস্তায় এক ব্যাক্তিকে দাড়িয়ে শৌচাগারের কাজ করছে দেখে ক্রুশেভ মন্তব্য করলেন, ইন্ডিয়ানরা দেখি একেবারেই অসভ্য, রাস্তায় দাড়িয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে। নেহেরু এতে দারুন লজ্জা পেলেন ও অপমানিত বোধ করলেন। প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু সেইবার আর সুযোগ হল না।
কিছুদিন পর নেহেরু গেল মস্কো সফরে। ক্রুশেভ তাকে নিয়ে ‘মস্কো বেল’ দেখতে বের হলেন। অপ্রতাশিতভাবে নেহেরু, ক্রুশেভের ভারত সফরকালের অপমানের উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলেন। এবারো রাস্তায় দাড়িয়ে একজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছিল আর তা দেখে নেহেরু ক্রুশেভের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলো। ক্রুশেভ খুব বিরক্ত হয়ে গেলেন আর লোকটিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে তুমি? লোকটি বিনীতভাবে উত্তর দিলো, “স্যার, আমি ইন্ডিয়ান এম্বেসির একজন কর্মচারী!”
মোহাম্মাদ আলি
নিউইয়র্কে সফরকালে, এক পার্টিতে বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মাদ আলির সাথে ভায়োলিনবাদক আইজ্যাক স্টানের সাথে পরিচয় হয়। ভায়োলিনবাদক স্টান মন্তব্য করেন, “বলতে পারেন আমরা দু জনই একই কাজ করি। আমরা দুজনই হাতদিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি।” আলি মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, ‘তবে আপনিই বেশি ভালো আছেন, আপনার গায়ে আঘাতের কোন চিহ্ন নেই।’
আবার একবার বিমানে ভ্রমনের সময়, বিমান উড়বার আগ মুহূর্তে আলিকে সিট বেল্ট বাঁধার কথা মনে করিয়ে দিলেন বিমানবালা। আলি উত্তর দিলেন, “সুপারম্যানের সিট বেল্ট বাঁধার প্রয়োজন হয় না।” আলির কথা শুনেবিমান বালাও চটপট উত্তর দিলেন, ‘সত্যিকার সুপার ম্যানদের বিমানে উঠারো প্রয়োজন হয় না।’
বঙ্কিম চন্দ্র ও দীনবন্ধু মিত্র
বঙ্কিম চন্দ্র ও দীনবন্ধু মিত্র দুজনে খুব ভালো বন্ধু ছিল। দীনবন্ধু মিত্র তখন ডাক বিভাগে কাজ করতো। আর সেই কারনে তাকে প্রায়ই বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেরাতে হতো। একবার আসামে গিয়ে সেখান থেকে বঙ্কিম চন্দ্রের জন্য কাপরের এক জোড়া জুতা কিনে এনেছিলেন। অন্য একজনের মাধ্যমে সেই উপহার বঙ্কিম চন্দ্রের কা’ছে পাঠিয়ে দিলেন। আর সাথে একটা চিরকুট দিলেন তাতে লিখা ছিল , “জুতো কেমন হয়েছে জানিও।” বঙ্কিম চন্দ্র উপহারটি পেলেন আর চিরকুটটি পড়ে হাসলেন। তারপর মজা করে দীনবন্ধু মিত্রকে উত্তর দিলেন “ঠিক তোমার মুখের মতো”।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম
একবার কাজী নজরুল ইসলাম সিরাজগঞ্জে এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। খাবার পর সবাইকে দই খেতেদেওয়া হল। কিন্তু দইটা ভালো ছিল না,পুরনো হয়ে গিয়েছিল। আর তাই দই খাওয়ার পর বন্ধুর দিকে তাকিয়ে কাজী নজরুল ইসলামমজা করে বললেন , “তুমি কি এই দই তেঁতুল গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এলে?”
জর্জ ডাব্লিউ বুশ
২০০৪ সালের নভেম্বরের দিকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টজর্জ ডাব্লিউ বুশ কানাডা সফরে যান। সেই সময় ইরাক অভিযানের কারনে কানাডার সাধারন মানুষ তাঁর উপর খুব বিরক্ত ছিল, যার ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ অটোয়া পৌঁছানোর আগেই জনগনের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। অসংখ্য কানাডিয়ান রাস্তায় নামে বিক্ষোভ করে আর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। আর এই পরিস্থিতিতে বুশ একটুও বিচলিত না হয়ে হাস্যজ্ঝল ভাবে বলে উঠে, “কানাডিয়ানদের আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ। আমাকে হাত ছুড়ে বরণ করে নেওয়ার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই।” জটিল পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্ত রেখে এমন মন্তব্য করতে পারা সত্যিই প্রশংসনীয়।
উইলিয়াম মরিস
ইংরেজ কবি ও চিত্রশিল্পী উইলিয়াম মরিস প্যারিস ভ্রমণের সময় অধিকাংশ সময় আইফেল টাওয়ারের রেস্তরায় সময় কাটাতেন। মরিসের এক বন্ধু এই ব্যাপারটা খেয়াল করে বললেন, আইফেল টাওয়ারে তুমি এমন কি পেলে যে প্রায় পুরো সময় ওখানেই কাটাচ্ছো? আর মরিস ও মজা করে বললেন, সারা প্যারিসের মধ্যে একমাত্র ওখানে বসলেই ওই বিশ্রি জিনিসটা আমার চোখের আড়ালে থাকে!
মার্ক টোয়েন
অনেক দিন আগের কথা তখন আমেরিকার ট্রেন গুলো খুব আস্তে মানে ধীর গতিতে চলতো। এমনও হতো সকাল ৮টার ট্রেন রাত ৮টায় আসবে কিনা সেই ব্যাপারে সবাই সন্দিহান, ট্রেন লেট করতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেইসময় বিখ্যাত রম্য সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন আমেরিকা থেকে কোন এক জায়গায় ভ্রমনের জন্য ট্রেনে উঠেছিলেন। কিছুক্ষণ পর মার্ক টয়েন এর ট্রেনের বগীতে টিকেট চেকার আসলো। মার্ক টোয়েন গম্ভীর হয়ে চেকারের দিকে একটি “হাফ টিকেট” এগিয়ে দিল। ওনার মতো একজন বয়স্ক মানুষের হাতে হাফ টিকেট দেখে টিকেট চেকার অবাক। তার প্রশ্ন, কি মশাই, আপনি হাফ টিকেট কেটেছেন কেন? গোঁফ, মাথার চুল সবই তো সাদা, আপনি কি জানেন চৌদ্দ বছরের বেশি হলে তার বেলায় আর হাফ টিকেট চলে না? মার্ক টোয়েনের সোজা উত্তর , যখন ট্রেনে উঠেছিলাম তখন তো বয়স চৌদ্দ বছরই ছিল, কে জানতো ট্রেন গন্তব্যে পৌছাতে এত লেট করবে?
বিয়াট্রিস লিলি
বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা বিয়াট্রিস লিলি নিউইয়র্কে ঘুরতে গিয়ে একবার একটি ডিনার পার্টিতে গিয়েছিলেন। তাঁর টেবিলে সেদিন বসেছিলো মডেলিং জগতের নতুন সুন্দরি এক মডেল। অন্যান্য টেবিল থেকে অনেকের চোখ বারবার ওই সুন্দরি মডেলের দিকে যাচ্ছিলো। পাশের টেবিলেই বসেছিল বিয়াট্রিসের এক পরিচিত লোক। উনি নিজেকে সামলাতে না পেরে কাগজে ছোট্ট একটি নোট লিখে ওয়েটারকেদিয়ে বিয়াট্রিসকে পাঠালেন, তোমার টেবিলের ওই সুন্দরী মেয়েটা কে? বিয়াট্রিস উত্তর দিলেন, “আমি”।
কেমন লেগেছে বিখ্যাত ব্যক্তিদের মজার ঘটনা পড়ে? ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করুন আপনার বন্ধুদের সাথে। আরও কোন বিখ্যাত ব্যক্তির ভ্রমণের সময়ের মজার ঘটনা জানা থাকলে আপনিও জানান মন্তব্য করে।
Comments
Post a Comment