লিখেছেন :ব্যসাচী দাশ
সাড়ে তিন শ’ বছরের জমিদার বাড়ি।
লিখেছে:
সব্যসাচি দাস
আমাদের বাড়ি থেকে রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ির দূরত্ব ছয় থেকে সাত কিলোমিটার হবে। বাড়িতে গেলে রিক্সা বা অটোরিক্সায় চড়ার থেকে মোটরসাইকেলে চড়তে বেশ ভাললাগে। যানজটের শহরে থেকে থেকে হাত পায়ে জং ধরে গেছে। খোলা রাস্তায় মোটরসাইকেলের দুর্বার গতি হৃদয়টা হালকা করে দেয়। সুতরাং জমিদার বাড়ি যাবার যান মোটরসাইকেল। আমার ছোট ভাই সৌরভের লাল রঙের সুন্দর একটা মোটরসাইকেল আছে। দুপুরে খেয়ে আমরা তিনজন রওনা হলাম রাজা রুদ্র রায়ের বাড়ি..
মোটরসাইকেলের গতি ঘণ্টায় পঞ্চাশ কিলোমিটার আমার তাতেই মনে হচ্ছিল আমরা বুঝি কোন হাওয়াই জাহাজে চড়ে বসেছি। শরতের বিকেল। দুই ধারে ঘন সবুজ বন। বিস্তীর্ণ মাঠে মধ্য বয়সের ধান গাছ মৃদু হাওয়ায় শরীর ছেড়ে দিয়েছে.. কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমি শরত স্বপ্নে হারিয়ে গেলাম। এর মধ্যে সৌরভ বলল, দাদা এই পাশটা দেখেন। সৌরভ জানে প্রকৃতির রূপলীলায় হারিয়ে যাবার আমার বহুদিনের অভ্যাস। ছোট একটা সরু খালের ওপাশে সারি সারি নারিকেল গাছের দল। সবার বয়স প্রায় সমান। শরতের পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের হেলানো রশ্মি পুরো পরিবেশটা ঐন্দ্রজালিক করে তুলেছিল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে এর মধ্যে লীন হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না। স্ত্রী, সূর্যের এমন নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো হঠাৎ জ¦লে ওঠার রূপ দেখে বিমোহিত! একটু এগিয়ে হাতের বামে মোড় ঘুরে বড় রাস্তার পাশ থেকে নেমে গেছে রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ির মন্দির এবং মঠের এলাকা। সৌরভকে বললাম আগে মন্দিরে ঢোক। গাড়ির গতি কমিয়ে আমরা মন্দিরের রাস্তায় ঢুকে পড়লাম.. শুরুতেই শতবর্ষের প্রকান্ড বটবৃক্ষের দেখা। গাছটার দিকে খুব খেয়াল করলে এক ধরনের সৌজন্যতা উপলব্ধি করা যায়। সে যেন আমাদের মত দর্শনার্থীর অপেক্ষায়.. জিজ্ঞেস করতেই শত বছরের শত কথা বলতে শুরু করবে। যাগ্যে! গাছকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করে বউয়ের কাছে নতুন খেতাবের দরকার নেই। সৌরভ গাড়ি রাখল। আমরা মূল মন্দিরের এলাকায় প্রবেশ করলাম। ডান পাশে সারি সারি বিশাল আকৃতির কারুকার্য খচিত মঠ। বাম পাশে কেবল অবকাঠামোর অংশ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে প্রচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। আরও একটু এগিয়ে মূল কালীমন্দির। মন্দিরের ওপরে লেখা ‘সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির’ মুঘল আমলে স¤্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকালে প্রতিষ্ঠিত। মন্দির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে খুব ভাল করে আকাশ বাতাস এবং শত শত বছরের পুরনো স্থাপত্য দেখে নিজের ভেতর এক বিস্ময় বোধ অনুভূত হলো। জীবন সত্যিই সুন্দর! সঙ্গে মনে পড়ে গেল বইতে পড়া এখানকার পূর্বের ইতিহাস- ঐতিহ্যের কথা। এক সময় ভারত বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত এখানে মহাধুমধামের সঙ্গে প্রত্যেক বাড়িতে দুর্গাপূজা হতো। রায়েরকাঠির রাজা রাজকুমার রায় দোলযাত্রা উপলক্ষে রায়েরকাঠিতে একটি বিশাল মেলার আয়োজন করতেন এবং এখানে বর্তমান ফুটবল খেলার মাঠে প্রতিবছর সেই মেলা হতো। আমার স্ত্রী বাড়ির কাছে এত সুন্দর রূপনগরী দেখে এক রকম আত্মহারা। দেখ কি চমৎকার আর বিস্ময়ে ঘেরা এলাকাটা, পিরোজপুরের পর্যটন এলাকা হিসেবে এর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ দরকার।
প্রতিটা মঠের একেবারে চূড়ার দিকে। ছোট ছোট অসংখ্য ছিদ্র। প্রথমে বুঝতে না পারলেও কিছু সময়ের মধ্যে আমার স্ত্রী বুঝতে পেরেছে। কিসের ছিদ্র! বেলা গড়িয়ে সূর্য যখন পাটে, তখন এক ঝাঁক শালিক কিচির-মিচির শব্দ করতে করতে প্রথমে মঠের গায়ে আশ্রিত গাছের ডালে তারপর যে যার বাসায় ঢুকতে শুরু করল। একটু বলে রাখি এখুনি সন্ধ্যা নামেনি। মঠে বসবাসরত পাখিরা সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার আগে বেলা থাকতে থাকতে একবার এসে ঘুরে যায়। এরমধ্যে আমাদের সামনের মঠটিতে এক ঝাঁক গাঢ় সবুজ টিয়াপাখি এসে পড়ল! সঙ্গে তাদের নিজস্ব শব্দের বাক্যবিনিময়। আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে পাখিদের কোলাহল দেখছি। আমার স্ত্রীর চোখে-মুখে প্রশান্তির ছায়া। সৌরভ বলল দাদা এদিকে আসেন বৌদিকে নিয়ে। মন্দির এলাকার সব থেকে উঁচ মঠের ভেতরে স্থাপিত ২৫ মণ ওজনের বিশাল আকৃতির সেতপাথরের শিবলিঙ্গ। হিন্দুদের প্রভাবশালী দেবতাদের মধ্যে শিব অন্যতম। যে কারণে প্রতিবছর শিব চতুর্দশীতে দুধ দিয়ে শিবের পূজা-অর্চনা করা হয়। মঠের ভেতর শিবলিঙ্গটি সত্যি বিশাল আকৃতির। কথিত আছে উপমহাদেশের বিশাল আকৃতির শিবলিঙ্গের মধ্যে রায়েরকাঠি মঠের শিবলিঙ্গ অন্যতম। সন্ধ্যা নামতে কিছু বাকি। আমার স্ত্রী বলল চল জমিদার মশায়ের বাড়িটা দেখে যাই । এখানে একটু বলে রাখি। মন্দির এবং মঠ থেকে রাজা রুদ্র রায়ের বাড়ি পায়ে হাঁটলে পাঁচ মিনিট! সৌরভও বলল চলেন রাজাসাহেবের বাড়িতে। মোটরসাইকেলে খুব তাড়াতাড়ি রাজার বাড়িতে পৌঁছে যাই। বাইরে থেকে পুরনো দালানের ধ্বংসাবশেষ দেখা গেলেও ভেতরে জনমানুষের বসতি রয়েছে। রয়েছে রাজার বংশধররা। প্রবীণ এক ভদ্র লোকের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাত হয়। তিনি আমাদের জানান, প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছর আগে এখানে জমিদার বংশ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বার ভূঁইয়াদের অন্যতম মহারাজ কিংকর রায়ের বংশধর রুদ্রনারায়ণ স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে সুন্দবনের এই এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করেন। এই রায় বংশ জঙ্গল কেটে আবাদ শুরু করে। ফলে তাদের নামানুসারে এর নাম রাখা হয় রায়েরকাঠি। এই জমিদার বাড়িতে নির্মিত হয় রাজভবন, অতিথিশালা, নাট্যশালা এবং অসংখ্য মন্দির এমন সব অশ্চর্যজনক স্মৃতি মন্থনের ভেতর সন্ধ্যা নেমে আসে ভাঙ্গা বাড়ি অন্ধকার হতে থাকে, নুপূর বলে চল সন্ধ্যা ঘোর হওয়ার আগে বাড়ি ফিরে যাই।
সুত্র-দৈনিক জনকণ্ঠ
Comments
Post a Comment